বাংলাদেশে ৭১ এর ইতিহাস

 বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সাল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক বছর। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে এক সংগ্রাম, যার ফলস্বরূপ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

১৯৭১ সালের পটভূমি:

বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে গভীর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এবং অর্থনৈতিক ফারাক ছিল। পূর্ব পাকিস্তান ছিল অত্যন্ত জনবহুল, তবে পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্র ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। বিভিন্ন ক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তান অবহেলিত ছিল—এখানে সামরিক, প্রশাসনিক, এবং অর্থনৈতিক অবিচার ও বৈষম্য ছিল।

১৯৭০ সালের নির্বাচন:

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন পায়, যা তাদের সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যার চেয়েও বেশি। তবে পাকিস্তান সরকার, যে তখনও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে, আওয়ামী লীগের প্রতি অনীহা দেখায় এবং তাদের সরকার গঠনের অনুমতি দেয় না।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ:

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী "অপারেশন সার্চলাইট" নামে একটি সামরিক অভিযান শুরু করে, যার উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদীদের দমন করা। ঢাকায়, বিশেষ করে মিরপুর, শাহীদী, লালবাগসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় নিরপরাধ সাধারণ জনগণের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। শহরের হাজার হাজার মানুষ হত্যার শিকার হয়, এবং লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে পালিয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনা:

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের পর, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি দেশে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করা।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ভারত, মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ হিসেবে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে সহানুভূতি প্রকাশ করে এবং ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধ তীব্র রূপ ধারণ করে এবং ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ বিজয়ী হয়।

১৬ ডিসেম্বর: বিজয় দিবস:

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারতীয় ও মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ হয়। এই দিনটি "বিজয় দিবস" হিসেবে পালন করা হয়, এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এটি একটি অমলিন দিন।

মুক্তিযুদ্ধের পর:

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। তবে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ছিল বিপুল; লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়, অসংখ্য নারী ধর্ষিত হয় এবং দেশটি আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু স্বাধীনতার পর, দেশটি পুনর্গঠন এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যায়।

উপসংহার:

বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি অবিস্মরণীয় সংগ্রাম, যা জাতির ইতিহাসে চিরকাল চিহ্নিত থাকবে। এটি শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে একটি বিরাট আন্দোলন ছিল, বরং এটি মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা, এবং জাতীয় মর্যাদার জন্য একটি অসীম ত্যাগের মূর্ত প্রতীক।

Post a Comment

Previous Post Next Post